লিভার সিরোসিস বা যকৃতের শীর্ণতা ( Cirrhosis of the Liver) ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা
Cirrhosis of the Liver |
লিভার সিরোসিস বা যকৃতের শীর্ণতা ( Cirrhosis of the Liver)
যকৃতের কোষ সমূহের মধ্যস্থ সংযোজক তন্তু সমূহের পুরাতন প্রদাহ ও এর ফলে যকৃত দৃঢ় কঠিন হয়ে ওঠে। যকৃতের কোষগুলি সংকোচন হতে থাকে, এই সংকোচন অবস্থাকে সিরোসিস অব দি লিভার বলে। প্রথমে লিভারের প্রধান ধমনী বা পোর্টাল ভেনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা ও তার পাশের কানেকটিভ টিস্যু সময় আক্রান্ত হয়, ফলে ঐ টিস্যু সমূহ নষ্ট হয়ে যায় এবং সেখানে আবার নতুন টিস্যু জন্মায়। লিভারের কোষগুলি ক্রমশঃ অসুস্থ হইতে থাকলে এবং লিভারের ফাইব্রাস টিস্যু সমূহের বৃদ্ধি পেয়ে পোর্টাল ভেনের মধ্যে দিয়া রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি হলে লিভারটি শুকায়ে ছোট হয়ে যায়।ইহারই নাম লিভার সিরোসিস। লিভারের কোন পুরাতন প্রদাহ হইতেও ইহা সৃষ্টি হইতে পারে। যারা অতিরিক্ত মদ পান করে তাদের এই পীড়া বেশী হয়।
লিভার সিরোসিস সাধারণতঃ ৪ ভাগে ভাগ করা যায়।
(১) এট্রাফিক সিরোসিস ( Atrophic Cirrhosis)
যকৃতের সঙ্কোচনকারী সিরোসিস পীড়া। ইহাতে যকৃতের আকার অতিশয় ক্ষুদ্র ও ওজনও সেই অনুপাতে হ্রাস হয়। যকৃতের নিম্নপ্রান্ত হাত দিয়ে পরীক্ষা করলে যকৃত এবড়ো থেবড়ো বুঝা যায়।
(2) হাইপারট্রফিক সিরোসিস (Hypertrophic Cirrhosis)
বিবর্ধিত সেরোসিস পীড়া। এই পীড়ায় যকৃত অত্যন্ত বড় হয় এবং এত বড় হয় যে নিম্নাংশের নাভীর নিকট পর্যন্ত নামিয়া আসে। যকৃতে অত্যধিক রক্ত সঞ্চয়ই ইহার প্রধান কারণ
(৩) ফ্যাটি সিরোসিস (Fatty Cirrhosis)
চর্বি কর্তৃক সঙ্কোচন। ফ্যাটি সিরোসিস পীড়ায় চর্বি অতিশয় বেশী পরিমাণে থাকে। ফ্যাটি সিরোসিস পীড়ায় যকৃতের সঙ্কোচন না হয়ে বৃদ্ধি হইয়া থাকে, যকৃত এবড়ো থেবড়ো না হয়ে মসৃন হয় খুব কমই অমসৃন হয়ে থাকে।
(৪) গ্লাইসোনিয়াম সিরোসিস (Glysonian Cirrhosis) বা পেরিহিপেটাইটিস
এই পীড়ায় যকৃতের আকৃতি অতিশয় বিকৃতি ও সংকুচিত হয় এবং সংযোজক তন্তু সকল অতিশয় স্থুল হয়ে থাকে। সংযোজক তন্তু সমূহের অতিশয় বৃদ্ধি ঘটে। যারা এলকোহল পান করে তাদের এই পীড়া বেশী হয়ে থাকে।
খালি পেটে অধিক পরিমাণে তীক্ষ্ন পদ্যপানই ইহার প্রধাণ করণ। অতিরিক্ত গরম মশলাযুক্ত গুরুপাক খাদ্য খাওয়া, উপদংশ, রিকেট, বহুমূত্র, গাউট, ম্যালেরিয়া, অস্বাস্থ্যকর স্থানে বাস, বার বার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া, টাইফয়েড, যকৃতের রক্তাধিক্য, কয়লা খনিতে কাজ করা, টিউবারকুলোসিস প্রভৃতি কারণে লিভার সিরোসিস হয়ে থাকে।
ব্যবহৃত হোমিপ্যাথিক ঔষধাবলীঃ-
নাক্স ভমিকা-৩০, ২০০। অতিরিক্ত মদ্যপান, অধিক উগ্রদ্রব্য আহার অমিতাচার। ইন্দ্রিয় পরায়ণ ও ক্রোধ প্রবণ ব্যক্তিদের যকৃত প্রদাহ ও সিরোসিসে ইহা উপকারী। রাত্রি গাগরণে অভ্যস্ত ব্যক্তিগণের যকৃতের বৃদ্ধিতে ইহা উপকারী। যকৃত বা লিভার বাড়িয়া খুব শক্ত হয় এবং তাহার উপর কোনরূপ চাপ বা ভার সহ্য হয় না এমনকি কাপড়ের আঁট পর্যন্ত সহ্য হয় না, এই সঙ্গে অনেক সময় কলিক বেদনা থাকে। পেটে অত্যধিক বায়ু সঞ্চয় হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা অথবা মলমূত্রের বেগ জন্মায়। “পোর্টাল ভেন” এর অবরোধ জনিত ন্যাবা অথবা জল উদরী। রোগী চিৎহইয়া শয়ন করিতে পারে না। খাওয়ার দুই এক ঘন্টা পর পেটে কনকনানি, মাথাঘোরা গা বমি বমি, বুকজ্বালা, বমি প্রভৃতি দেখা দেয়। শেষ রাত্রির দিকে প্রায়ই খুম ভাঙ্গিয়া যায় এবং ভোরে পুনরায় ঘুম আসে। ন্যাবার সহিত শিরঃপীড়া, মুখে তিক্তস্বাদ, সমগ্র গায়ের ত্বক ও চক্ষু শ্বেত হলুদবর্ণ যুক্ত, গাঢ় ও পীতবর্ণের প্রস্রাব, পৈত্তিক মল, রোগী অতিশয় দুর্বল।
আর্সেনিক-৩০, ২০০। ম্যালেরিয়া জনিত সিরোসিসে লিভার ও প্লীহা দুইটিরই বৃদ্ধি ঘটিলে এবং পেটের দোষ, শোথ প্রভৃতি থাকিলে ইহা উপকারী। উগ্র ঔষধাদি অপব্যবহারের পর ইহা প্রায়শঃ প্রয়োজন হয়। রোগী অতিশয় অস্থির, উদ্বগযুক্ত এবং মৃত্যুভয়ে ভীত। গা বমি বমি এবং বমন। খাদ্য পানীয় প্রভৃতি বমি করিয়া ফেলে। অম্ল, তিক্ত, শ্লেষ্মাময়, সবুজ অথবা রক্তযুক্ত বমি হয়। অনেক সময় কালো বর্ণের বমি হয়ে থাকে। লিভার অতিরিক্ত বড় হয় বা শুকিয়ে যায় সেই সাথে সর্বাঙ্গীন শোথ দেখা যায়। রোগীর প্রচুর পিপাসা থাকে। রোগী বার বার সামান্য পানি পান করে। অনেক সময় পানি পান করার সাথে সাথেই বমি করে ফেলে। রোগী উষ্ণদ্রব্য এবং ঝাল, মিষ্টি, টক দ্রব্য খাইতে পছন্দ করে। সর্ব শরীর হরিদ্রাবর্ণ ধারণ করে এবং জ্বালা বোধ করে। রাত্রিকালে চিৎভাবে শয়ন করিলে, জ্বরতাপ অবস্থায়, সামান্য পরিশ্রমে, হাঁটিতে ও নড়াচড়ায় হাঁপানি ও হৃৎপিন্ডের বৃদ্ধি ঘটে।
ব্রায়োনিয়া-৬, ৩০, ২০০। যকৃতের বিবৃদ্ধি এবং জন্ডিস। যকৃত বিশেষতঃ দক্ষিণ অংশ কুক্ষি প্রদেশে একটি বোঝার ন্যায় বোধ হয়। তৎসহ ক্ষতবৎ বেদনা, চাপে অত্যনুভুতি থাকে এবং রোগী নড়িতে পারে না। প্রত্যেকবার নড়িলে, স্পর্শ করিলে দীর্ঘশ্বাস ফেলিলে লিভারের যন্ত্রণার বৃদ্ধি হয়। টাটানি ব্যথা, জ্বালা, পেটের উপরিভাগেও বেদনা, পোড়া মাটির ন্যায় শুষ্ক কঠিন মল। মুখে তিক্তস্বাদ, ডান কাঁধের পাখনায় বেদনা। জিহ্বা শ্বেত বর্ণের অথবা পীত বর্ণের ক্লেদাবৃত ও শুষ্ক। কোষ্ঠবদ্ধতা, উপর্যুপরি ২।৩ দিন মলের বেগ থাকে না। সকালের দিকে মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরানো, বমিবমি ভাব ও বমন। পিপাসা প্রচুর এবং রোগী অনেক্ষণ অন্তর প্রচুর পানি পান করে।
ম্যাগ্নেশিয়া মিউর-৬, ৩০, ২০০। লিভার টাটানি বেদনা, বেদনা কিছুদিন পার হওয়ার পর লিভারটি বড় ও শক্ত হইয়া উঠে। ভয়ানক কোষ্ঠবদ্ধতা, কাটিয়া কাটিয়া মল বাহির হয়। ইহা ছড়া বড় বড় গোলার মত শুষ্ক মল এবং গাঁট ভেড়ার লাদির মত মলও হইতে দেখা যায়। লিভারে বেদনা, অস্বস্তি এবং বৃদ্ধি পায়। রোগী ডান পাশে শুইতে পারে না। বেদনা ও ফোল এত বেশী যে স্পর্শ করা যায় না। বেদনা লিভার স্থান হইতে পিঠের দাঁড়ায় এবং পাকস্থলীর উর্ধাংশে পর্যন্ত পরিচালিত হয়। খাদ্য গ্রহনের সাথে সাথে বেদনার বৃদ্ধি পায়। রোগীর শরীর হলদে হয়ে যায়, রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয় এবং খুবই ক্লান্ত বোধ করে। যথেষ্ট ক্ষুধা থাকে কিন্তু খাইতে পারে না। জিহ্বায় হলুদ বর্ণের লেপ এবং তাতে দাঁতের দাগ পড়ে। পা দুটি ফুলে যায়, শ্বাসকষ্ট থাকে এবং বুক ধড়ফড় করে। সঞ্চালনে উপশম কিন্তু বিশ্রামে বৃদ্ধি। ডান পাশে শুইলে ও রাত্রিকালে কাশির প্রকপ বাড়ে।
মার্কসল-৬, ৩০, ২০০। লিভার সিরোসিসে ইহা একটি প্রথম শ্রেণীর ঔষধ। লিভার প্রদাহ, লিভার শক্ত ও বড় হইয়া লিভারে বেদনা। রোগী বামপাশ ব্যতিত শুইতে পারে না। রাত্রিকালে রোগ যন্ত্রণার বৃদ্ধি হয়। হাত-পা, মুখ ও উদরে শোথ। প্রথমে যকৃত প্রদেশে সামান্য আড়ষ্ট বেদনার অনুভূতি থাকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ বেদনাটি বৃদ্ধি পাইয়া অতিশয় টাটানিযুক্ত হইয়া উঠে, নড়াচড়ায় বা স্পর্শ করিলে যাতনার বৃদ্ধি পায়। জন্ডিস অথবা লিভার পীড়ায় রোগীর প্রায়ই নিষ্ফল মলবেগ থাকে। বারবার পেট কনকন করে এবং স্বল্প পরিমাণে মলত্যাগ করে।
ল্যাকেসিস-৩০, ২০০। মাতালদের পীড়ায় ল্যাকেসিক উপকারী। লিভারের সমস্যায় জন্ডিস, লিভার ষ্ফোটক ইত্যাদিতে ডানদিকে ভয়ানক ব্যথা- সেজন্য কাপাড় পর্যন্ত কোমরে রাখিতে পারে না। লিভারে টাটানি ও দপদপানি। লিভারের মধ্যে জ্বালা অনুভব হয়। ল্যাকেসিসের পেটের টাটানি ব্যথা অধিক এবং উহা প্রায় সব সময়ই থাকে। মলত্যাগ কালীন অর্শের ছোট ছোট হাতুড়ী মারার ন্যয় যন্ত্রণা হয় এবং রক্তপাত হয়। এলকোহলিক সিরোসিসের ইহা উত্তম ঔষধ।
কোন মন্তব্য নেই